হযরত আনাস রাযি.

হযরত আনাস রাযি.-এর সাথে হাজ্জাজের গোস্তাখী কাহিনী জানবো আজ

এ কাহনী আলী বিন যায়েদ বিন জাদআন এভাবে বর্ণনা করেছেন :

একবার হযরত আনাস রাযি. হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছাকাফির নিকট গমন করলেন। সে নেহায়েত জালেম ও অত্যাচারী ছিল। এ বেয়াদব

(হাজ্জাজ)তাঁকে দেখে অশালীন বাক্য উচ্চারণ করল : 

‘অথর্ব কোথাকার! বৃদ্ধ হয়েও

অশান্তির আগুন জ্বালাচ্ছ। 

বিলগেটস এর জীবন কাহিনী
নামাযের গুরুত্ব
ওযু করার নিয়ম ও নিয়ত

কখনো আবু তোরাবের পক্ষাবলম্বন করেন, কখনো ইবনে যুবায়েরের দিকে ঝুঁকে পড়েন, কখনো ইবনুল আশয়াছের নিঃশ্বাস ভরেন আবার কখনো ইবনুল আরুফের গান গাইতে থাকেন। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, একদিন আমি কুমিরের মতো আপনার চামড়া তুলে ফেলব! ঠিক যেভাবে গাছের ছাল তোলা হয়। তোমাকে আমি এমনভাবে প্রহার করব, যেভাবে কাটাযুক্ত গাছের পাতা ঝরানো হয়। এমন দুষ্টু লোক—যে কৃপণ ও মুনাফেক—তার প্রতি আমি বড় বিস্মিত।’হযরত আনাস রাযি. হাজ্জাজের এসব অশালীন কথা শুনে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এ কথা কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন? হাজ্জাজ নির্দ্বিধায় বলে উঠল,—‘আমার উদ্দেশ্য একমাত্র তুমিই! আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন! (নাউযুবিল্লাহ।)

আলী বিন ইয়াজিদ বলেন : হযরত আনাস রাযি. হাজ্জাজের নিকট হতে চলে যাওয়ার পর বললেন, আল্লাহর শপথ! সে আমার ছেলের বয়সী না হলে নিশ্চয় আমি তার কথার উত্তর দিতাম। তারপর হযরত আনাস রাযি. হাজ্জাজের সাথে সংঘটিত সকল ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করে খলিফা আবদুল মালেক বিন মারওয়ানের নিকট প্রেরণ করলেন। এতে আবদুল মালেক বিন মারওয়ারন হাজ্জাজের নামে একটি চিঠি লিখলেন এবং তা ইসমাইল বিন আবদুল্লাহ বিন আবুল মাহারি মাওলা বিন মাখদুমের হাত মারফত হাজ্জাজের কাছে পাঠালেন।

ইসমাইল পত্রখানা নিয়ে হাজ্জাজের কাছে না গিয়ে প্রথমে হযরত আনাস রাযি.-এর নিকট উপস্থিত হন। আরজ করেন, আপনার সাথে হাজ্জাজের ব্যবহারে খলিফা খুবই ব্যথিত হয়েছেন। কিন্তু একজন হিতাকাক্ষী বন্ধু হিসেবে আপনাকে বলছি, খলিফার দৃষ্টিতে হাজ্জাজের যে মূল্য-মর্যাদা রয়েছে, তা অন্য কারো জন্য নাই। আমিরুল মুমিনীন লিখেছেন, হাজ্জাজ যেন আপনার নিকট উপস্থিত হয়। আর আমার পরামর্শ হল, আপনি স্বয়ং হাজ্জাজের নিকট গমন করুন। তা হলে সে আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এরপর আপনি তার নিকট হতে চলে এলে সে আপনার মর্যাদা বুঝতে পারবে এবং তার দৃষ্টিতে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।তারপর ইসমাইল হাজ্জাজের নিকট উপস্থিত হল এবং খলিফার পত্রটি প্রদান করল ।

পত্রখানা পাঠ করে হাজ্জাজের চেহারা বিগড়ে গেল। সে নিজের চেহারা হতে ঘাম মুছতে লাগল। বলল, আল্লাহ তায়ালা আমিরুল মুমিনীনকে ক্ষমা করুন! আমি বুঝতে পারিনি, আমিরুল মুমিনীনের ধারণা আমার প্রতি এভাবে পরিবর্তন হয়ে যাবে! ইসমাইল বর্ণনা করেন, এরপর হাজ্জাজ পত্রটি আমার প্রতি ছুঁড়ে মারল। সে ভাবল, পত্রখানা আমি পড়ে নিয়েছি। এরপর সে বলতে লাগল, আমাকে তাঁর [হযরত আনাস রাযি.]-এর নিকট নিয়ে চল! আমি বললাম, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! তিনি নিজেই আপনার কাছে তাশরিফ রাখবেন। আপনার তাঁর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এরপরআমি হযরত আনাস রাযি.-এর খেদমতে হাজির হলাম।

বললাম, আপনি হাজ্জাজের নিকট গমন করুন! তিনি তার নিকট উপস্থিত হলে হাজ্জাজ তাঁকে দেখে খুশি হল। বলল, হে আবু হামযাহ! আপনি আমার বিরুদ্ধে আমিরুল মুমিনীনের কাছে অভিযোগ দায়েরে জলদি করে ফেলেছেন। আমি আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি, তা কোনো দুশমনি ও হিংস্রার কারণে করি নি বরং এর কারণ ছিল, ইরাকিরা চায় না যে, তাদের উপর আল্লাহ তায়ালার হুজ্জতও প্রবলতা প্রতিষ্ঠিত হোক। আপনার সঙ্গে এরূপ ব্যবহারের কারণ ছিল, ইরাকের মুনাফিক ও পাপিষ্ঠরা যেন বুঝে যায়, আমি যখন রাষ্ট্রীয় বিষয়ে আপনার মতো ব্যক্তিত্বকে সমীহ করি না, তখন আমার নিকট তাদের কী মূল্য থাকতে পারে? এখন আমি আপনার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি! আপনি আমার প্রতিসন্তুষ্ট হয়ে যান।

কিছু বিশেষ আমল সম্পর্কে জেনে নিন
প্রয়োজনীয় কিছু দোয়া

হযরত আনাস রাযি. বললেন, যাবৎ না সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে এ কথা প্রচার না হয়েছে এবং আমি নিজ কানে আপনার মুখ হতে নিজেকে দুষ্টুলোক বলে না শুনেছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আমিরুল মুমিনীনের কাছে পত্র লিখিনি। আপনি আমাকে দুষ্টু বলে সাব্যস্ত করেছেন, অথচ মহান আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআনে আনসার বলে অভিহিত করেছেন। আপনি আমাকে কৃপণ বলেছেন, অথচ আমরা নিজেদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আপনি আমাকে মুনাফিক বলেছেন, অথচ আমরা মদিনায়। মুহাজিরগণ আগমনের পূর্ব হতেই বসবাস করছি। আল্লাহর কাছে যেসব কাজ হারাম, আপনার সেসব কর্মকাণ্ডকে ইরাকিরা যেন হালাল জ্ঞান করে এর জন্য আপনি নিজের ধ্যান-চিন্তা অনুযায়ী আমাকে সিঁড়ি বানাতে চেয়েছিলেন। অথচ আপনার ও আমার মাঝে আল্লাহই বিচারক।

তিনি নেক কাজে সন্তুষ্ট আর মন্দ কাজে অসন্তুষ্ট। বান্দার শাস্তি ও পুরস্কার তার হাতেই নিহিত। তিনি মন্দের বদলে মন্দ আর পুণ্যের বদলে পুণ্যই প্রদান করেন। আলাহর শপথ! খ্রিষ্টানগণ মুশরিক ও কাফির হওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তিকে একদিনের জন্যও হযরত ঈসা আ.-এর খেদমত করেছে দেখে, তবে তারা তাকে যথাযোগ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খেদমত দশ বৎসর করেছি। অথচ আপনি আমার এ খেদমতের কোনো মূল্যই দিলেন না। আপনার কাছ থেকে আমি কোনো কল্যাণ না পেলে আমি শোকরিয়া আদায় করব আর কোনো অকল্যাণ হলে আমি তজ্জন্য ধৈর্য ধারণ করব, যাবৎ না আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য মুক্তির উপায় তৈরি করে দেন।

আলী বিন যায়েদ বলেন, হাজ্জাজের নিকট খলিফার প্রেরিত পত্রখানার বিষয়বস্তু ছিল এই—‘আম্মা বাদ! তুমি সেই ব্যক্তি, যে নিজের কর্মকাণ্ডে সীমা অতিক্রম করে গিয়েছ। হে আঙ্গুরদানা চর্বণকারিণী নারীর সন্তান, আল্লাহর শপথ! আমি মনোস্থ করেছি, তোমাকে ঠিক বাঘ-শৃগালের মতো বিতাড়িত করব। তোমাকে এমন নিকৃষ্ট বানাব যে, তুমি আপন মায়ের পেট থেকে দুর্ভাগ্য নিয়ে ভূমিষ্ঠের সময়ের আকাঙ্ক্ষা করবে। তুমি যে দুর্ব্যবহার হযরত আনাস রাযি.-এর সাথে করেছ, আমি তা জেনে গিয়েছি। আমার ধারণামতে এর দ্বারা তোমার আমিরুল মুমিনীনের পরীক্ষা নেওয়া উদ্দেশ্য ছিল— আমিরুল মুমিনীনের মধ্যে সম্মানবোধের উৎস না থাকলে আমি এর পরের পদক্ষেপ নিব।

সুতরাং তোমার এবং তোমার পূর্বপুরুষের উপর যাদের চোখ ছিল কোঠরাগত, চোখের পলক ছিল মিলিত, পা ছিল সরু ও চিকন আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক! তুমি কি তোমার পূর্বপুরুষের তায়েফে অর্জিত ব্যক্তিত্বকে ভুলে গিয়েছ? তারা কত নিকৃষ্ট ও কমজাত ছিল! নিজ হাতে তারা মানুষের জন্য কূপ খনন করত!

নিজের কাঁধে পাথর বহন করত! যখন আমার এ পত্রখানা তোমার নিকট পৌঁছাবে এবং তুমি তা পাঠ করবে, তখন সকল কাজ ফেলে হযরত আনাস রাযি.-এর খেদমতে হাজির হয়ে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অন্যথায় তোমার উপর এমন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করব, যে তোমাকে কোমর ধরে টেনে-হেঁচড়ে তার সামনে হাজির করবে আর তিনিই তোমার ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তুমি মনে কর না, আমিরুল মুমিনীন তোমার সম্পর্কে অবহিত নন। প্রত্যেক সংবাদ অনুষ্ঠানের একটি সময় থাকে। অচিরেই তুমি তা জানতে পারবে।

তোমার উচিত আমার পত্রকে অবহেলা না করা অতি সত্বর হযরত আনাস রাযি.-এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাঁর ও তাঁর সন্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা। অন্যথায় আমি তোমার উপর এমনব ব্যক্তিকে কর্তৃত্ব প্রদান করব, যে তোমার মুখোশ খুলে দিবে এবং তোমার শত্রুদেরকে তোমার উপর হাস্য-রসের সুযোগ করে দিবে। ওয়াস সালাম।’

হযরত আনাস রাযি.-এর মৃত্যু বসরাতে ৯১ হিজরি সনে মতান্তরে ৯২ হিজরি বা ৯৩ হিজরি সনে হয়েছিল। বসরায় মৃত্যুবরণকারী সাহাবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশেষ সাহাবি।