সুশাসন

সুশাসন (Good Governance)

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় ক্রমশ পরিবর্তন এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোর উন্নততর ম্যাকানিজম হিসেবে সুশাসন প্রত্যয়টি সূচনা। তত্ত্ব সুশাসন (Good Governance) প্রত্যয়টি বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে একটি বহুল আলোচিত ধারণা হিসেবে আবির্ভূ হয়েছে। এর মাধ্যমে কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, রাষ্ট্র এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে তার নির্দেশক। মূলত সুশাসন কোন রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি পরিচালনার পদ্ধতি, শাসক শাসিতের সম্পর্কের স্বরূপ।

জাতীয় রাজনীতির ধারা, আইনের স্বরূপ ইত্যাদির মূর্ত প্রতিচ্ছবি। সাম্প্রতিককালে দাতা রাষ্ট্র বা সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক অনেকাংশে সুশাসনের উপর নির্ভরশীল বা প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সুশাসন বর্তমানকালের একটি জরুরি চাহিদা যা দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনব্যবস্থায় উন্নয়নের জন্য একান্ত আবশ্যক। সরকার ও প্রশাসনকে জনস্বার্থে ব্যবহার করার জন্য আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুশাসনের বিকল্প নেই।

জাপানি মেয়েদের রুপের গোপন রহস্য জেনে নিন
হযরত আনাস রাযি আঃ এর জিবন কাহিনী সম্পর্কে জানুন
গর্ভ অবস্থায় কি কি করবেন?

সুশাসন কি (What is Good Governance)/ সুশাসন কাকে বলে

সুশাসন সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে আমাদেরকে শাসন ও সরকার সম্পর্কে অবহিত হতে হবে।

ক. সরকার (Government) :

সরকার হলো একটি প্রতিষ্ঠান। যে কোন দেশকে পরিচালনার জন্য একটি সংগঠন অত্যাবশ্যক। আর সরকারই হলো সে সংগঠন। তাঁর সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রকাশিত হয়। সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলি পরিচালনার জন্য তিনটি বিভাগ (Organs of Gorvernment) রয়েছে।

যথা :

  1. আইন বিভাগ (Legislature),
  2. শাসন বিভাগ (Executive) এবং

iii. বিচার বিভাগ (Judiciary)।

খ.শাসন (Governance) :

শাসনের (Governance) ধারণা প্রসঙ্গে লোক প্রশাসন (ঢা.বি.) বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, "Governance is such a concept where authoritos exercises for the organizational management to sustain development." Landell Mills and Serageldin 43, "Government may be taken as denoting how people are rulled and how the affairs of the state are administered and regulated."

এখানে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে যোগসূত্রের মাধ্যমে সুষ্ঠু শাসনকার্য পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। উপরিউক্ত ধারণার প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি যে, শাসনব্যবস্থা হলো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয় এবং জনগণের শাসিত হওয়ার পদ্ধতি এবং রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।

সুশাসন সম্পর্কিত ধারণা (Concept about Good Governance)

সুশাসন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে সমাজের প্রত্যাশা ও রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের মধ্যকার সুসমন্বিত মিল, “শাসিতের কাম্য শুধুমাত্র শাসন নয়, বরং সুশৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিক শাসনও বটে।" (Good Governance is the harmony between performance of the state and aspiration of the society) আর এটিই হলো সুশাসন (Good Governance)। উল্লেখ্য যে, সুশাসন ধারণাটি ৯০ দশকে বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠী ও এজেন্সি তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চাপিয়ে দিয়েছে।

সুশাসন সম্পর্কে দু'টি ধারণা পাওয়া যায় । যথা

১. বিশ্ব ব্যাংকের মতামত (World Bank's View)

তাঁদের মতে, "Good Governance is a manner in which power is exercised in the management of a country's economic and social resources for

development." বিশ্বব্যাংক  এর মতে, সুশাসন নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে-

সরকারি কাজে দক্ষতা।

স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা।

বৈধ চুক্তির প্রয়োগ।

জবাবদিহিমূলক প্রশাসন।

স্বাধীন সরকারি নিরীক্ষক।

বহুমুখী সাংগঠনিক কাঠামো।

প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধতা।

আইন ও মানবাধিকার সংরক্ষণ।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি।

২. পশ্চিমা মতামত (Western View) :

পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ পণ্ডিত ও তাত্ত্বিকগণের মতে, সুশাসন বলতে গণতান্ত্রিক শাসন বা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে বুঝায়। তারা সুশাসনের চারটি দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা, সুশাসন হলো অধিকতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা। সুশাসনের প্রক্রিয়া অবশ্যই আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। পশ্চিমা মতবাদে এ ধরনের স্বাধীনতা নেই।

তারা মনে করে সুশাসনের অর্থ হলো গণতান্ত্রিক সরকার। মূলত কথাটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখার উপযুক্ত সময় বর্তমানে এসেছে। সুশাসন নিশ্চিতকল্পে নিম্নোক্ত ম্যাকানিজমগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে-

১। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ (Separation of Judiciary

form the executive),

২। জনপ্রশাসন সংস্করণ (Public Administration Reformation),

৩। বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralization),

৪। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা শক্তিশালীকরণ (Strengthening Accountability

and Transparency)

৫।দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপ (Anti-Corruption Measures)..৬। জনগণের

অংশগ্রহণ (Peoples Participation)।

এই বিষয়গুলো নিশ্চিতকল্পে যে কোন দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যদি প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছত নিশ্চিত করা যায় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হবে বর্তমানে বাংলাদেশে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সম্ভব হয়েছে তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এদেশ একধাপ এগিয়ে গেছে বে মনে করা হচ্ছে। তবে এ পথ অনেক দীর্ঘ ও কষ্টকর। তাই আরও কতিপয় কঠোর পদক্ষেপ ও সর্বস্তরের জনসমর্থন নিে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে হবে। আর এটা একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে জাতির প্রত্যাশা।

প্রশাসনিক আইন (Administrative Law)

শৈল্পিক সমাজের দ্রুত চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রশাসনের ভূমিকা দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। জনগণও বর্তমানে অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের অধিকতর হস্তক্ষেপ কামনা করছে। যে সমস্ত বিষয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেসরকারি খাতে ন্যস্ত ছিল, বর্তমানে তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং সরকারের এই নিয়ন্ত্রণ পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে।

প্রশাসকদের অনেক প্রশাসনিক নিয়ম প্রণয়ন করতে হচ্ছে। গত দুই দশক ধরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের বহুবিধ ভূমিকাকে কার্যকর করে তোলার উদ্দেশ্যে আইন, সংসদ ও শাসন বিভাগকে আইন বা নিয়ম-কানুন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করেছে। আর এ ধরনের অর্পিত ক্ষমতার বলেই প্রশাসকদের আইন প্রণয়ন ও স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতার পরিমাণও বেড়ে চলেছে। সংসদ কর্তৃক অর্পিত প্রশাসকদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ও প্রশাসনিক কর্মপদ্ধতি সবকিছু মিলেই হলো প্রশাসনিক আইন (Administrative Law)।

প্রশাসনিক আইন কি (What is Administrative Law)

সাধারণ অর্থে, সুষ্ঠুভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার নিমিত্তে প্রণীত নিয়ম-কানুনকে প্রশাসনিক আইন বলা হয়। তবে প্রশাসনিক আইনের অবশ্যই একটি আইনগত ভিত্তি (Legal frame work) থাকবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, প্রশাসনিক আইন সরকারি কর্মচারী ও প্রশাসনিক সংস্থার স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা নির্ধারণ করে থাকে। বৃহৎ অর্থে প্রশাসনিক আইন লোক প্রশাসন সম্পর্কিত যাবতীয় আইনকে বুঝায়। এ অর্থে প্রশাসনিক সংস্থার উপর প্রভাব বিস্তারকারী সব ধরনের সংসদীয় আইন, সনদ, প্রস্তাব, আইন-কানুন, বিচার বিভাগীয় কর্মকাণ্ড, আদেশ প্রভৃতিকে বুঝায়।

প্রশাসনিক সংস্থার কাঠামো ক্ষমতা কর্মপদ্ধতি, কর্মচারী ব্যবস্থাপনা প্রভৃতির সাথে প্রশাসনিক ক্ষমতার সম্পর্ক এবং অর্থসংক্রান্ত পদ্ধতি প্রশাসনিক আইনের অন্তর্ভুক্ত। অধ্যাপক ডব্লিউ. এ. রবসন মন্তব্য করেন, “লোকপ্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত সব ধরনের আইনই প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনিক আইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।” (Administrative law is recognized to be no more or no less than the law relating of public administration.) নেজিংস বলেন, “প্রশাসন ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলির হচ্ছে সম্পর্কযুক্ত আইনই প্রশাসনিক আইন।” (Administrative law is the law relating if administration, powers and duties of administrative authority.)

প্রশাসনিক আইনের পরিধি (Scope of Administrative Law)

প্রশাসনিক আইনের পরিধি মোটামুটি ব্যাপক। ইউরোপের দেশগুলোতে পূর্বে লোক প্রশাসনকে প্রশাসনিক আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করা হতো। ১৯৩৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক নিযুক্ত কমিটি কয়েকটি বিষয়কে প্রশাসনিক আইনের পরিধির অন্তর্ভুক্ত করেন।

প্রশাসনিক আইনের বৈশিষ্ট্য

বিগত দুই দশক ধরে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের আইনসভা শাসন বিভাগের নিকট আইন প্রণয়নের ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। বর্তমানে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে সামগ্রিক উন্নতি সাধন করতে হলে সামাজিকখাতে আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। সামাজিক বিষয়ে আইনকানুন প্রণয়নের জন্য নতুন ধরনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। প্রশাসকগণ যাতে এই ধরনের নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের পারেন সে জন্য তাদের স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

প্রশাসনিক আইনের বিকাশের কারণ

পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রশাসনিক আইনের সূচনা হয়েছে। তবে প্রশাসনে জনগণের উদ্যোগ, অংশগ্রহণ হ্রাস পেয়েছে বলেই প্রশাসনিক আইনের বিকাশ ঘটেছে বলে অনেকে ধারণা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। জনগণের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাষ্ট্রে প্রশাসকদের কর্মকাণ্ড ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এহেন জটিল পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এছাড়া আধুনিক প্রশাসনের বিভিন্ন জটিল দিক আইনসভার সদস্যদের পক্ষে ওয়াকিফহাল হওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক আইনের সূত্রপাত হয়েছে।