ভাষা আন্দোলন কি
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এর সূচনা হলেও ক্রমে এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। দুই পর্বে বিভক্ত এ আন্দোলন ১৯৪৮ সালে অনেকটা শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হলেও ১৯৫২ সালে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। শুধু শিক্ষিত শ্রেণী নয়, বরং সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে এর প্রভাব পড়ে।এ পর্যায়ে শুধু ভাষার বৈষম্য নয়, আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালির প্রতি বৈষম্য পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
এর ফলে ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে একক রাজনৈতিক মঞ্চে নিয়ে আসে এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন করে তোলে। এভাবে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি, উদার দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা, সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে নতুন পরিমণ্ডলে নিয়ে যায়। ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতির পরবর্তীকালে সংগঠিত প্রতিটি আন্দোলনে প্রেরণা আসে। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষাই বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে প্রেরণা যোগায়। সুতরাং বলা যায় যে, ভাষা আন্দোলনের ফলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে, প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
একুশে বই মেলার তাৎপর্য
বিশ্বায়ন কাকে বলে এবং বিশ্বায়ন এর প্রভাব
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংক্ষিপ্ত জীবনী
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ভাষা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাসসহ সকল ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কেবল ধর্মের ভিত্তিতে প্রায় এক হাজার মাইলের অধিক উর্দু বনাম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে উদ্দেশ্য ও যুক্তি পাকিস্তানের মতো বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ঐক্য বন্ধন সৃষ্টির জন্য একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজনীয়তা প্রথম থেকেই শাসকগোষ্ঠী অনুভব করেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের বড় অংশ ছিলেন উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের উচ্চ পদবীধারীরা ছিলেন মোহাজের।
জিন্নাহ ও তাঁর উত্তরসূরি লিয়াকত আলীর মন্ত্রিসভা কে তাই ‘মোহাজের মন্ত্রিসভা বলা হতো। এক হিসেবে দেখা যায় ১৯৪৭-৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট ২৭ জন গভর্নর জেনারেল / প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১৮ জন ছিলেন মোহাজের ।
এদের আবার অধিকাংশের ভাষা ছিল উর্দু। পূর্ব বাংলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণকারী খাজা পরিবার ছিলেন উর্দুভাষী। যে কারণে প্রথম থেকেই শ্রেণী স্বার্থে তাঁরা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন। এমনকি খাজা নাজিমুদ্দিন যিনি পূর্ব বাংলার উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন তিনি ছিলেন উর্দুভাষী।
এছাড়া পূর্ব বাংলার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক ইস্পাহানি, আদমজিসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত যারা মুসলিম লীগ নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ছিলেন উর্দুভাষী। স্বভাবতই তারা ও পশ্চিম পাকিস্তানি জনগোষ্ঠী রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বত্র নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য এ ভাষাকে বেছে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বহুদিন থেকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে চর্চা করায় তারা উর্দুর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রভাবশালী অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি হওয়ায় তারা সকলে এ ভাষার পক্ষে ছিলেন ।
ভাষা বিতর্কের উৎপত্তি ও বিকাশ
পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই উর্দু বনাম বাংলা নিয়ে ভাষা বিতর্ক দেখা দেয়। ১৯০৬ সালে যখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগের এই অধিবেশনেও এ প্রশ্ন ওঠে। তবে তখন পর্যন্ত এই সমস্যাটি তত প্রকট হয়নি। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ সভাপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের একটি উদ্যোগ নিলে এ. কে. ফজলুল হকের বিরোধিতায় তা সফল হয়নি।
তৎকালীন পূর্ব বাংলা সরকারের সময়ও ভাষা নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের প্রাক্কালে এ বিতর্ক মৃদুভাবে দেখা দেয়। কংগ্রেস নেতারা হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে পাল্টা ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ উর্দু ভাষাকে সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা দাবি করেন।
এ প্রসঙ্গে খুব ক্ষুদ্র অংশ হলেও বাংলার পক্ষে দাবি ওঠে। তবে ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় তখন ভাষা বিতর্ক নতুন রূপ নেয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার দিনের জন্য সভা-সমাবেশ ভাষা আন্দোলনের কারণ আপাতদৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের যে কারণ জানা যায় তা হচ্ছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এটি এর প্রধান কারণ হলেও বিষয়টি আরো গভীর এবং বিশ্লেষণের দাবিদার । ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল বাঙালির সংস্কৃতির প্রশ্ন, ছিল তার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নও।
রোযার গুরুত্ব ও ফযিলত
তারাবীহ নামায পড়ার সঠিক নিয়ম, নিয়ত ও দোয়া
আন্তর্জাতিক নারী দিবস এর ইতিহাস
ভাষা আন্দোলনের কারণ
ভাষা আন্দোলনের নিম্নলিখিত কারণ চিহ্নিত করা যায়:
১. সাংস্কৃতিক কারণ : ভাষার ওপর আঘাত পুরো জাতি এবং তার সংস্কৃতির ওপর আঘাতেরই শামিল । বাঙালি জাতিসত্তাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্যই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত করা হয়েছিল । অতএব বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়াও ছিল বেশ জোরালো। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা গোড়াতেই তমদ্দুন মজলিস গঠনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে সালেই ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এরও আগে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের লেখা প্রবন্ধ নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতজনেরা কেনো বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম
রাষ্ট্রভাষা করা উচিত তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। পরবর্তীকালে পত্রপত্রিকা সমূহেও এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ফোরামেও বিষয়টি আলোচিত হয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে দাবিটি জোরালো ভাষায় উত্থাপিত হয়।
২. অর্থনৈতিক কারণ : ভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলন হলেও এর পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশের কথা অস্বীকার করা যায় না। পূর্ব বাংলার বেশির ভাগ মানুষই ছিল একভাষী। তাদের একটা অংশ বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োজিত ছিল এবং অনেকে চাকরি প্রত্যাশী ছিল। বিকাশমান এ মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভাষাজনিত জটিলতায় নিজেদের অবস্থান হারানোর আশঙ্কায় ছিল। একই আতঙ্কে ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত ব্যক্তিরাও।
৩. রাজনৈতিক কারণ : ভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এটি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পরিণত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা নেপথ্যে জড়িত হয়ে পড়ে, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে কংগ্রেস পার্টির সংসদ সদস্যরা পার্লামেন্টেই গোড়া থেকে বাংলা ভাষার বিষয়টি নিয়ে দাবি উত্থাপন শুরু করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালিরা রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত হচ্ছিল।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্তার
উল্লেখিত পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই ভাষা প্রশ্নে বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত অংশ বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার হয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এক অধিবেশনে নিম্নপর্যায় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু মুসলিম লীগের সকল সদস্যের ভোটে তা অগ্রাহ্য হয়।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এর প্রতিবাদ করে প্রথমে ছাত্রসমাজ। ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ছাত্রসমাজ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এ পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। নবগঠিত পরিষদ ১১ মার্চ হরতাল আহ্বান করে। ঐদিন হরতাল চলাকালে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হন।
শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল আলমসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩-১৫ মার্চ ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। শুধু ঢাকা নয় ঢাকার বাইরে সর্বত্র ১১ মার্চ হরতাল ও অন্যান্য দিনের কর্মসূচি পালিত হয়।
আন্দোলনের তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তিতে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ও ব্যবস্থাপক সভায় রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিষয় উত্থাপনে রাজি হন। ১৯৪৯-১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের বিস্তার W ১৯৪৯ – ৫১ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব বলা যায়। আরবি হরফে বাংলা লেখার সরকারি ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
উদ্দেশে ১৯৪৯ সালের মার্চে আকরাম খানকে সভাপতি করে ‘পূর্ববাংলা ভাষা কমিটি' গঠিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিবাদ জানায় । যদিও শেষ পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে প্রতি বছর ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালিত হতো। ১৯৫০ সালে আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে গণ পরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির সুপারিশে বলা হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে এর উর্দু।