বিশ্বায়ন শব্দের অর্থ হল বিশ্বকে একীভূত করা। বিভিন্ন দেশের মধ্যকার দূরত্ব ও তারতম্য কাটিয়ে ওঠা।সাধারণ অর্থে বিশ্বায়ন বলতে বোঝায় বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও পরিবেশের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে একই দিকে উত্তরণ। উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ইতোমধ্যেই বিভিন্ন আলোচনা, পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে দেখা যায় যে, বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই বিদ্যমান।
বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাবের ফলে বিশ্বের সম্পদ ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে সার্বিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহ। এ দেশগুলো তাদের অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো নিয়ে বিশ্বায়নের সঠিক পথে এগোতে পারছে না।
কম্পিউটার রক্ষনাবেক্ষন করবেন কিভাবে জেনে নিন
জাপানি মেয়েদের রুপের গোপন রহস্য জেনে নিন
হযরত আনাস রাযি আঃ এর জিবন কাহিনী সম্পর্কে জানুন
বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ও তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।বিশ্বায়নের অর্থ ও এর গতি-প্রকৃতি : মালয়েশিয়ার বাণিজ্য ইউনিয়ন কংগ্রেসের কর্মকর্তা জি রাজাস্কেরন বলেন,বিশ্বায়ন অর্থ হল বাজার উন্মোচিত হওয়া ও বিনোয়োগে আকৃষ্ট করানো। খুব সাধারণভাবে বিশ্বায়ন হলো দ্রব্য উৎপাদন, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির আন্তঃদেশীয় অবাধ প্রবাহ।
এ সংজ্ঞায় বিশ্বায়নকে এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা অর্থনৈতিক, তথ্যবিপ্লব, যোগাযোগ প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশ্বকে প্রভাবিত করে। অর্থনৈতিক দিকথেকে বিশ্বায়ন হচ্ছে সমগ্র বিশ্বকে একটি মাত্র বিশাল বাজারে পরিণত করা। এধরনের ব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশের মধ্যকার সকল প্রকার বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হয়।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় যে মূল বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেগুলো হল বাজার সম্পর্কীয় আইন, সরকারি ব্যয় হ্রাস, সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, বেসরকারিকরণ এবং সরকারি সম্পদ ধারণার বিলোপ সাধন। এখানে বিশ্বায়নকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান ধারায় বিশ্বায়ন হল স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং পূর্ব ইউরোপ ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির ওপর উদার গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির আধিপত্য বিস্তারকারী বার্তাবাহক স্বরূপ।
বিশ্বায়নের বিস্তরণ:
বর্তমানে আমাদের জীবনযাত্রার প্রায় সকলক্ষেত্রে বিশ্বায়ন বিস্তার লাভ করেছে। যেমন:
প্রযুক্তি বিশ্বায়ন :
শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই এই ধরনের বিশ্বায়ন শুরু হয়। ওই সময়ে যে সকল যুগান্তকারী যান্ত্রিক আবিষ্কার সাধিত হয় তা বিভিন্নদেশে আদান-প্রদান ও ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসতে শুরু করে। যান্ত্রিক উৎপাদন থেকে যান্ত্রিক যাতায়াত ও যোগাযোগের সুফল ভোগ করতে মানুষ তৎপর হয়ে ওঠে। আর এভাবে ঘটে প্রযুক্তিগত বিশ্বায়নের বিস্তার।তথ্যগত বিশ্বায়ন : তথ্য আদান-প্রদানে প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্বায়নের গতিকে বহু গুণে ত্বরান্বিত করেছে। ঘরে বসেই মুহূর্তের বদৌলতে এখন ঘরে বসেই ব্যবসায়-বাণিজ্য করা যাচ্ছে। তাই তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিতে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া হয়েছে গতিময়।
অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন :
প্রযুক্তিগত ও তথ্যগত বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন আবির্ভূত হয়েছে মহিরুহ হয়ে।মূলধন, শ্রম বিনিয়োগ, উপকরণ স্থানান্তর, বাজার উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড এখন আর দেশের গণ্ডি মেনে চলছে না।বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিকে যেভাবে প্রভাবিত করছে তাতে কোনো একটি দেশের পক্ষে আর বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব নয়।সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ অনেকক্ষেত্রে অপসংস্কৃতির শিকারে পরিণত হচ্ছে।
বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিক :
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত প্রসারে আজ পৃথিবী যে সত্যি সত্যিই ছোট হয়ে আসছে তার প্রমাণ পেতে বেশি দূর যেতে হয় না। ঘরে বসেই কম্পিউটার, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কয়েক মুহূর্তেই সমগ্র বিশ্বের খোঁজ-খবর জেনে যাওয়া আর কল্পনার বিষয় নয়। ফলে বিশ্বায়নকে উপেক্ষা করার কোনো পথ নেই।
১।বিশ্বায়নের যেসব ইতিবাচক দিক রয়েছে তার মধ্যে নিম্নলিখিত দিকগুলো উল্লেখযোগ্য।
২।বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন হচ্ছে।
৩।বিশ্বায়নের ফলে যে বৃহৎ বাজার ব্যবস্থার ব্যাপ্তি হয়েছে, তাতে বৃহদায়তন উৎপাদন ও বিপণন সহজসাধ্য হয়েছে।
8।জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মধ্যে পরস্পর গ্রহণ বর্জনের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে।
৫।অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
৬। আন্তর্জাতিক সংঘাত হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে ইত্যাদি।
গর্ভ অবস্থায় কি কি করবেন?
মাইক্রোসফট উইন্ডোজ এর জন্য ফ্রী অ্যাপস
ইউটিউব প্রিমিয়াম কি
বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিক :
বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি লক্ষ করা যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতির আওতায় বিশ্বায়ন উন্নত দেশের জন্য বিশ্বসম্পদের দ্বার খুলে দিলেও দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশের জন্য তা একটি বড় অভিশাপও বটে। এর নেতিবাচক দিক:
১ । বিশ্বায়নের ফলে দরিদ্র দেশের মেধা অবাধে পাচার হচ্ছে ধনী দেশে। এতে গরিব দেশ আরো গরিব এবং ধনী দেশ আরো ধনী হচ্ছে।
২। বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দরিদ্র দেশের বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ফলে বেকার হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক।
৩। বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষা করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে।
৪। বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটছে ইত্যাদি।
বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশ :
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণত বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাবই বেশি লক্ষ করা যায়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি আমাদের স্পর্শ করেছে কিন্তু এর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ও মোকাবেলা করার মতো পরিবেশ বা উপাদানসমূহ বর্তমানে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত নেই।
ফলে অবাধ বাজারের নামে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দাতাগোষ্ঠী বিভিন্ন কঠোর শর্ত আরোপের কারণে দেশীয় মুদ্রা ও পুঁজির বাজার কোনো সুসংহত কাঠামো অর্জন করতে পারে নি। দেশে রপ্তানির পরিমাণ প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়েনি অন্যদিকে এ দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘মানব উন্নয়নকে বাদ দিয়ে কখনো বিশ্বায়ন সম্ভব নয়। যেসব দেশের মানব উন্নয়নসূচক অত্যন্ত কম তারা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের মানব উন্নয়নসূচক নিম্ন অবস্থানে বিদ্যমান। তাই বর্তমান অবস্থায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বাংলাদেশের জন্য সত্যিই দুরূহ ব্যাপার।বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কম দামে ভালো পণ্য উৎপাদন করে বাজার দখল করা।
এক্ষেত্রে আমাদের পণ্য আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কাছেই মার খাচ্ছে। সেখানে বিশ্বায়নের ফলে অন্যান্য শক্তিশালী দেশের সঙ্গে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। উন্নতবিশ্ব বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক বাজারে প্রবেশের তাগিদ দিচ্ছে।
অথচ অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলে এশিয়ার মুদ্রাবাজার ক্রমাবনতিশীল। অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিশ্বজনীন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবার সামর্থ্য অর্জন করতে পারে নি। তাই বিশ্বায়নের এই যুগে চুপচাপ বসে না থেকে এর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন৷বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহের করণীয় :
বিশ্বায়নের তীব্র প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হলে কতকগুলো নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপান। তাই বিশ্বায়নের এই যুগে চুপচাপ বসে না থেকে এর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে গ্রহণ করতে হবে। যেমন :
১। রাষ্ট্রের ভৌতকাঠামোর উন্নয়ন, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির কাজে লাগে তেমন অবকাঠামো (যেমন- টেলিযোগাযোগ বা তথ্য—হাইওয়ে) উন্নয়নে সবিশেষ যত্নবান হতে হবে।
২। সামাজিক, অর্থনৈতিক বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা খাতে দক্ষ জনশক্তি বিনিয়োগের প্রয়োজন।
৩। তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে নিত্যনতুন চিন্তাভাবনা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন করতে হবে।
৪। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
৫। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। ইত্যাদি।
আধুনিক সভ্যতার গতিশীল চক্রের এক অবশ্যম্ভাবী ফল বিশ্বায়ন। তাই বিশ্বায়নকে নব্য উপনিবেশবাদ বলে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। বিশ্বায়নকে যত নেতিবাচক বিশেষণেই ভূষিত করা হোক না কেন, বিশ্বায়ন এগিয়ে যাবে তার আপন গতিতে। তাই এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে কোনো রাষ্ট্রই দূরে থাকতে পারে না।
তবে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া বিশ্বায়নের পথে অগ্রসর হলে তা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন তখনই ফলপ্রসূ ও কার্যকর হবে যখন এর সুফল সর্বত্র সমানভাবে বণ্টন করা যাবে। এজন্য প্রয়োজন সুষম মানের সম্পদ উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, সম্পদের সুষম বণ্টন কাঠামো। বিশ্বায়নের পথে বাংলাদেশের যাত্রা সফল হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।