ধাঁধা কী
ধাঁধা (Riddle) লোকসাহিত্যে অতি পরিচিত নাম। এর বৈচিত্র্য যেমন, তেমন এর সমৃদ্ধি। ধাঁদা বাধাঁধা শব্দ এসেছে ‘ধন্দ বা বন্ধ শব্দ থেকে, কোনো অভিধানকারের মতে আবার ‘দ্বন্দ্ব শব্দ থেকে। বন্ধ থেকে বাঁধা শব্দের উৎপত্তি; অর্থ ধোঁকা; সংশয়, দুরূহ সমস্যা, কৌতূহলজনক ও বুদ্ধি বিভ্রমকারী প্রশ্ন। রূপক, সংকেত, উপমা, তুলনা, অতিশয়োক্তি, শ্লোক ইত্যাদির সাহায্যে রহস্যপূর্ণ প্রশ্ন রচনা করা হয়। কমপক্ষে দুজনের
উপস্থিতিতে রূপক-সংকেত-উপমাদির মাধ্যমে প্রশ্ন করে সহজ উত্তর বের করা হয়। প্রশ্ন ও উত্তর মিশে ধাঁধা পূর্ণাঙ্গ হয়। ‘ধাঁধা মাত্রই রূপক (Metaphor)। এই রূপক সৃষ্টির একদিক উপমান (Signified), অন্যদিক উপমেয় (Signifier)। দুটি ভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটি সাদৃশ্য বা অনুরূপতা লক্ষ করা যায়, যাকে ধাঁধা বলে।
চ্যাট জিপিটি সম্পর্কে জানুন
ইউটিউব থেকে আয় করুন সহজে
প্রী টাইম বাথ সম্পর্কে জানুন
ধাঁধার সংজ্ঞা
যা ধন্দ লাগায়, তাই ধাঁধা। আভিধানিক সংজ্ঞায় যে রচনার বাহ্যার্থের আবরণে স্বরূপার্থ গূঢ়ভাবে অবস্থিতি করে তাহাকে ধাঁধা বলে। প্রত্যেক মৌলিক ধাঁধায় একটি কিংবা বিষয়ের দুটি বর্ণনা থাকে, একটি অস্তিবাচক আর একটি নেতিবাচক। অস্তিবাচক বর্ণনাটি রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু শ্রোতা একে সহজ অর্থেই বুঝে থাকে। এর মত বৈপরীত্য স্বরূপ নেতিবাচক বর্ণনাটি আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়। ধাঁধা প্রসঙ্গে বলি লোকশ্রুতিবিদ-“Durga Bhagwat বলেছেন, The riddle incorporates a question primarily and an answer secondarily”-এই বক্তব্যের মধ্যেই ধাঁধার প্রাণপরিচয়টি অত্যন্ত সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। যে বাক্য দ্বারা একটিমাত্র ভাব রূপকের সাহায্যে কর জিজ্ঞাসার আকারে প্রকাশ করা হয় তাঁকে ধাঁধা বলে।
বিখ্যাত জার্মান লোকবিজ্ঞানী Friedrcich তাঁরগ্রন্থে ধাঁধাকেan indirect presentation of an unknown object on order that the ingenuity of the hearer or reader may be exercised in finding it out' ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ একে বলেছেন, a sort of verbal puzzle; লৌকিক ধাঁধার ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞাটি যথার্থ বা বিখ্যাত সংজ্ঞা । শ্রোতা বা পাঠককে উত্তরটি বের করার জন্য চিন্তার সুযোগ দেয়া হয়। এজন্য ধাঁধা বর্ণনায় কিছু না কিছু চিত্র সংকেত বা ধ্বনিব্যঞ্জনা থাকতে হয়। এরূপ সংকেত ব্যঞ্জনাটি নানাভাবে আসতে পারে— বর্ণ, চিহ্ন, সংখ্যা, আকার, আচরণ, গুণধর্ম ইত্যাদির দিক দিয়ে সাদৃশ্য বা ভুলনা আরোপ করে।মোট কথা, সরল বুদ্ধিগম্য উক্তি যাতে প্রশ্ন থাকে যার উত্তরদানে প্রশ্নের মধ্যে অন্তর্নিহিত রসনিষ্পত্তির মজাটুকু উদ্ঘাটিত হয় তাকেই সরল ভাষায় ধাঁধা বলে।
ধাঁধা চর্চার উদ্দেশ্য ও উপলক্ষ
বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধাঁধা বিভিন্ন নামে প্রচলিত থাকলেও সব ধাধারই উদ্ এক। ধাঁধার প্রধান বিষয় হলো তার উত্তর। ধাঁধা এবং তার উত্তর উভয়ে মিলেই এক ধাঁধার পূর্ণাঙ্গ পরিচয়। উত্তর ছাড়া অর্থাৎ যেসব জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর নেই, কিন্তু জিজ্ঞাসার মধ্যেই উত্তর প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকে তাকে যেমন ধাধা বলা হয় না, তেমন আবার যে ধাঁধার মধ্যে কোনো প্রশ্ন নেই তাও ধাঁধা হতে পারে না। অঞ্চলভেদে ধার বিভিন্ন নামকরণ হলেও কোনো নামেই উপদেশ দেবার ভাব বুঝায় না। বরং ত পরিবর্তে কেবলমাত্র কৌতুক সৃষ্টি, রঙ্গরস, চমক লাগানো কিংবা বুদ্ধির পরীক্ষার বোঝায়। ডক্টর ওয়াকিল আহমদ ধাঁধা চর্চার উদ্দেশ্য ও উপলক্ষ সম্পর্কে নিম্নরূপ তুলে ধরেছেন”— মানব-দানব শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব। এখানে জীবন-মরণের বাজি থাকে।
১। সজ্ঞাদি অনুষ্ঠানে ধাঁধা বলা হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য। রাজা নির্বাচনের উপায় ধাঁধা।
২।এ বিবাহাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে বরপক্ষ ও কনেপক্ষ ধাঁধা চর্চা করে প্রধানত।
৩।বৃদ্ধি পরীক্ষার জন্য। এক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক ধাঁধা বলা হয় আপন আপন।
৪। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য।
৫. বিবাহ-বাসরে কৌতুক ও হাস্যরস উপভোগের জন্য ধাঁধা ধরা হয় ।
৬।ধাঁধার উত্তর দিয়ে রাজকন্যা ও রাজত্ব লাভ হয়।
৭। ধাঁধার উত্তর দিয়ে বর লাভ হয় এবং অর্থদণ্ড ও দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘটে।
৮। ধাঁধার মাধ্যমে ধর্ম-নীতি জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়।
৯।. ডোজসভায় আমোদ-প্রমোদের অঙ্গ হিসেবে ধাঁধা জিজ্ঞাসা করা হয়।
ধাঁধার শ্রেণিকরণ ও কত প্রকার
ধাধার বিষয় এত ব্যাপক যে সুনির্দিষ্টভাবে এর শ্রেণি-বিভাগ করা সম্ভব নয়। জামেরিকার বিখ্যাত লোকবিজ্ঞানী আর্চার টেলর তাঁর বিখ্যাত ‘English Riddles from Oral Tradition& গ্রন্থে বিষয়বস্তুর সাদৃশ্য অনুসারেই ধাঁধাকে ভাগ করছেন। আবার হেলসিঙ্কির পণ্ডিতগণ ধাঁধাকে উপমিত বস্তুর সঙ্গে ভাগ করার প্রস্তাব দেন। মনীষী রোলান্ড ধাঁধাকে লৌকিক ও সাহিত্যিক-এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। তাঁর আশরাফ সিদ্দিকীও টেপরের মতো উপমিত বস্তুর রূপবিচারে শ্রেণিবিভাগ করেছেন। আবার ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য ধাঁধাকে লৌকিক ও সাহিত্যিক এই দুই ভাগে করেও বাংলাদেশের নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী সেগুলোকে, নর-নারী, প্রকৃতি, পশু- গ্রহ-নক্ষত্র, দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত তৈজসপত্র, মানুষের আচার ব্যবহার, অহনীমূলক, অঙ্কের হিসাবমূলক বিষয়ে ভাগ করেছেন।এছাড়া আবার দেখা যায় যে, বিনাচরণের বিশেষত্বের উপরও বিশেষ প্রকৃতির ধাঁধার প্রচলননির্ভর করে। তাই কে লৌকিক ও সাহিত্যিক এই দুই প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। আবার আধ্যাত্মিক একে সাহিত্যিক ধাঁধার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লোক প্রশাসন কি সংজ্ঞা ও বিস্তারিত আলচনা
সুশাসন কি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা
ভাষা আন্দোলনের পটভুমি
লৌকিক ধাঁধার ভাগগুলো নিম্নরূপ
১. নর-নারী ও দেবদেবীবিষয়ক :
(ক) মানুষ ও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
(খ) ইতিহাস প্রসিদ্ধ পুরুষ ও নারী
(গ) পৌরাণিক চরিত্র
(ঘ) দেবদেবী
২. প্রকৃতিবিষয়ক :
(ক) উদ্ভিদ ও লতাপাতা সংক্রান্ত
(খ) আকাশ-গ্রহ-নক্ষত্র ও প্রকৃতি
৩. গার্হস্থ্য জীবনবিষয়ক :
(ক) আত্মীয় সম্পর্কীয় ও অনাত্মীয় কাছের মানুষ
(খ) খাদ্যবস্তু
(গ) দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিসপত্র
(ঘ) আচার, আচরণ, অভ্যাস
(ঙ) আচার, অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্ম,
৪. পশুপক্ষী ও কীট-পতঙ্গবিষয়ক
৫. বাদ্যযন্ত্রবিষয়ক
৬. আখ্যান বা কাহিনীমূলক
৭. গাণিতিক বা সংখ্যামূলক
৮. বিবিধবিষয়ক।
লৌকিক ধাঁধার মধ্যে যে বিষয়টি সহজ কথায় সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করা হয়, সাহিত্যিক ধাঁধায় তাই-ই বিচিত্র রূপ অলংকারের সাহায্যে ব্যক্ত করা হয়। সাহিত্যিক ধাঁধার ব্যবহার বৈদিক যুগ থেকে চলে আসছে। চর্যাপদ, চণ্ডীমণ্ডল, ধর্মমঙ্গল, শিবমঙ্গল কাব্যে, নাথসাহিত্যে, গোপীচন্দ্রের গানে, গোষ্ঠবিষয়ে, বাউলগানে, কবিগানে বহু সাহিত্যিক ধাঁধার সন্ধান পাই।
প্রকৃতিবিষয়ক
প্রকৃতিবিষয়ক ধাঁধাগুলো রচনায় যে সব গাছপালা বাঙালির গৃহাঙ্গিনায় নিত্য ফুলফল প্রসাব করছে, তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে কোনও অপরিচিত কিংবা দুর্লভ বিশল্যকরণী এদের উপজীব্য হয়নি। বাঙালির নিত্য পরিচিত ফলের মধ্যে নারিকেলের কতকগুলো বিশেষত্ব আছে। অতএব এ স্বভাবতই ধাঁধা রচয়িতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যেমন- ইকড়ের তলে তলে ভিকমতির ছানি, কোন দেশে দেখিয়াছ গাছের আগে পানী।-নারকেল কলাগাছ যে বাঙালির গৃহাঙিনায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে তার সুবৃহৎ পত্র প্রচার দ্বারা কি অদৃশ্য রহস্যের বাণী নিত্য ঘোষণা করছে, তাও বাংলার ধাঁধার ভেতর দিয়ে এভাবে ধরা পড়েছে।
ধাধার কিছু উদাহরণ / ধাধা উত্তর সহ
উদাহরণ থেকে ধাঁধা
১. বাগান থেকে বেরুলে টিয়ে
সোনার টোপর মাথায় দিয়ে ॥-আনারস
২।বনের মধ্যে থেকে বেরোল টিয়া
লাল টুপিখান মাথায় দিয়া।-কলার মোচা
৩।যত কাটে তত বাড়ে। পুকুর বা গর্ত
খেলে খাড়/না খেলে জড়ো।—বস্তা
৪।একটুখানি গাছে/রাঙা বউটি নাচে।-মরিচ
৫। হায় তরমুজ করব কি/বোঁটা না তার ধরব কি?-ডিম.
৬।একমায়ের দুই ছেলে/কেউ কাউকে দেখতে নারে।—চোখ
৭। কাঠের বেড়া ছনের ছাউনি/এর মধ্যে পুষ্কনি।-নারকেল
৮. আকাশেতে আছি আমি গগনেতে নাই ।
৯। কাননেতে আছি আমি অরণ্যেতে নাই৷-ক-অক্ষর
১০. কাঁচাতে কাঁচবরণ সর্বলোকে খায়।
১১. পোয়াকালে পিঁদে শাড়ি, জোয়ানকারে উলঙ্গ ।
১২. খাবার জিনিস নয়, তবু লোকে খায়
১৩. আগে যায় ফিরে চায়, ওদি তোমারকে
১৪. তিন অক্ষরে নাম তার, পানিতে করে বাস
১৫. মামুরা শিন্নি রান্ধে খায়
১৬. রক্তে ডুবু ডুবু কাজলের ফোঁট।