তালাক এবং তালাকের মাসালা

তালাকের বর্ণনা

তালাক আরবী শব্দ; ইহার অর্থ বর্জন করা। কতিপয় বাক্য দ্বারা বিবাহ সম্বন্ধ বিচ্ছেদ করিয়া দেওয়াকে শরীয়তে তালাক বলে। তালাক দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র স্বামীকে অর্পণ করা হইয়াছে, স্ত্রীর ইহাতে কোন ক্ষমতা নাই। স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিয়া দিলে স্ত্রী তাহা গ্রহণ করুক বা না করুক, তালাক হইয়া যাইবে। স্বামী তালাক দিলে স্ত্রীর তাহা রদ করিবার যেমন কোন ক্ষমতা নাই, তদ্রুপ নিজকে নিজে তালাক দিয়া স্বাধীন হইবার বাস্বামীকে বর্জন করিবার ক্ষমতাও স্ত্রীর নাই। অবশ্য স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দেয়, তবে সে তালাক দিলেও তালাক অর্পিত হইবে।তালাক এবং তালাকের মাসালা নিয়ে অনেক হাদিস আছে।

আল্লাহর নিকট তালাক অতি ঘৃণিত ও অপ্রিয় কাজ। বান্দাদের জরুরতে আইনত তালাক প্রথা জায়েয রাখা হইয়াছে বটে, কিন্তু যেমন তেমন কাজে তালাক দেওয়া বা লওয়া আল্লাহর নিকট বড়ই অপছন্দনীয়। অতএব, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে বর্জন করিতে হইলে উভয়েরই সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত দরকার। উভয়ের মধ্যে যাহাতে মিল-মহব্বত বজায় থাকে তাহার চেষ্টা করা সর্বদাই আবশ্যক।তালাক এবং তালাকের মাসালা নিয়ে আজ আলোচনা করবো।

 

কাবা ঘর নির্মানের ইতিহাস
হাদিস অনুযায়ী স্বপ্নের ব্যাখ্যা
প্রাণির ওষধি গুনাগুন ও উপকারিতা

তালাকের প্রকারভেদ :

সাধারণত তালাক তিন প্রকার। তালাকে রাজয়ী, তালাকে বায়েন মোখ্‌ফফাফা, তালাকে বায়েন মোগাল্লাযা তালাকে রাজয়ী : যাহাতে বিবাহ সম্পূর্ণ ভাঙ্গিয়া যায় না, স্বামী স্ত্রীকে এক তালাক, দুই তালাক দেওয়ার পর যদি পরিণাম বুঝিয়া মুখের কথায় বা আচার-ব্যবহারে ইদ্দত শেষ হইবার আগে স্ত্রীকে ফিরাইয়া লয়, তবে এইরূপ ফিরাইয়া লওয়া দুরস্ত হইবে। ইহাতে বিবাহ দোহরাইতে হয় না। ইহাকে রাজয়ী তালাক বলে ।

তালাকে বায়েন :

ঐ তালাককে বলে যাহা প্রয়োগে বিবাহ একেবারেই ছুটিয়া যায়। এক বা দুই তালাকে রাজয়ী দেওয়ার পর ইদ্দতের ভিতরে মুখের কথায় বা আচার-ব্যবহারে যদি স্ত্রীকে ফিরাইয়া না লয়, তবে তালাকে বায়েন মোখাফ্ফাফা হইয়া যাইবে। এমতাবস্থায় বিবাহ না দোহরাইয়া স্বামীর পক্ষে স্ত্রীকে রাখা জায়েয হইবে না এবং স্ত্রীর পক্ষেও উক্ত স্বামীর গৃহে বাস করা সিদ্ধ হইবে না।

তালাকে মোগাল্লাযা :

তালাকসমূহের মধ্যে ইহা সবচেয়ে অধিক গুরুতর। ইহা প্রয়োগে বিবাহ তো একেবারে টুটিয়া যাইবেই, তদুপরি তাহ্লীল ব্যতিরেকে (অর্থাৎ, ঐ স্ত্রীর ইদ্দতের পর অন্য কোন লোকের সহিত প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোন প্রকার শর্ত ব্যতীত বিবাহ দিয়া সহবাস হওয়ার পর সে স্বইচ্ছায় যদি তালাক দেয় বা মরিয়া যায়, তবে ইদ্দতের পর নূতনভাবে তাহাকে পুণরায় বিবাহ করিয়া আনিতে পারে, ইহাকে তাহলীল বলে) উক্ত স্ত্রী স্বামীর পক্ষে হালাল হইবে না।মনে রাখিবেন, তিন তালাক রাজয়ী হইতে পারে না।

এমনকি রাজয়ী উচ্চারণ করা সত্ত্বেও তিন তালাক হইয়া গেলে স্বামীর পক্ষে তাহাকে ফিরাইয়া আনিবার কোন ক্ষমতা থাকিবে না। এই জন্যই কোরআন-হাদীসে তিন তালাক দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা রহিয়াছে কারণ, তালাক এতই মন্দ জিনিস যে, যদি কেহ এক তালাক দিয়া রাজআত করিয়া বা বিবাহ দোহ্রাইয়া দুই তিন বৎসর পরে পুনরায় একতালাক দেয়, আবার কয় বৎসর পর আর এক তালাক দেয়, তবুও সব একত্রে মিলিয়া যোগ হইয়া তালাকে মোগাল্লাযা হইয়া যাইবে। এই জন্য তালাকের ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত । শব্দ ব্যবহারের বিচারে তালাক দুই প্রকার-সরীহ ও কেনায়াহ।

সরীহ ঃ সুস্পষ্ট অর্থবোধক, যাহাতে পরিষ্কার ছাড়িয়া দেওয়া বুঝায় যেমন, কেহ নিজ স্ত্রীকে বলিল, “আমি তোমাকে তালাক দিলাম বা আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিলাম বা ছাড়িয়া দিলাম।”

কেনায়া ঃ যে শব্দে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, যাহাতে তালাকের অর্থও হইতে পারে, অন্য অর্থও হইতে পারে। যেমন- কেহ তাহার স্ত্রী সম্পর্কে বলিল, “আমি তাহাকে দূর করিয়া দিলাম”, ইহার অর্থ তালাকও হইতে পারে এবং ইহাও হইতে পারে যে, “আমি আমার স্ত্রীকে সরাইয়া দিয়াছি”, তালাক দেই নাই। এরূপ অনেক শব্দ আছে। যেমন, কেহ নিজ স্ত্রীকে বলিল, “তুমি তোমার বাপের বাড়ী গিয়া থাক, আমি তোমার খবর আমিও রাখি না, আমার সহিত তোমার কোন সম্পর্ক নাই, তুমি আমার নও, তোমার নহি, আমার বাড়ী হইতে চলিয়া যাও, যেখানে ইচ্ছা যাইতে পার” ইত্যাদি।

অতএব, “সরীহ্” শব্দ দ্বারা তালাক দিলে তালাক দেওয়ার নিয়ত থাকুক আর না-ই থাকুক, এমনকি হাসি-ঠাট্টারূপে বলিলেও এক তালাক রাজয়ী হইবে। আর দুই তালাক বা তালাক তালাক বলিলে দুই তালাক রাজয়ী হইবে। তিন তালাক বা তালাক শব্দ তিনবার বলিলে এবং পরের দুইবারের দ্বারা তাকিদের ইচ্ছা না করিলে তিন তালাক বায়েন মোগাল্লাযা হইয়া যাইবে।সরীহ্ তালাকে নিয়তের প্রয়োজন হয় না। কেনায়া তালাকে নিয়তানুসারে তালাক অর্পিত হয় ।তালাকের বিভিন্ন মাসায়েল

১। যদি কেহ আপন স্ত্রীকে বলে, “তোমাকে তালাক দিলাম বা তালাক দিতেছি”, ইহাতে তালাক হইয়া যাইবে, কিন্তু তালাক দিব বলিলে তালাক হইবে না। অতএব, যদি কেহ তাহার স্ত্রীকে বলে যে, যদি তুমি অমুক কাজ কর তবে আমি তোমাকে তালাক দিয়া দিব। এইরূপ বলাতে সে কাজ করুক বা না-ই করুক তালাক হইবে না। অবশ্য যদি এরূপ বলে, “যদি তুমি অমুক কাজ কর তবে তোমাকে তালাক দিলাম বা.দিতেছি” তাহা হইলে উক্ত কাজ করিলে তালাক হইবে।

২। যদি কেহ তালাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইনশাআল্লাহ বলিয়া দেয় বা এরূপ বলে “খোদা চাহে তো তালাক”, তবে ইহাতে তালাক হইবে না। অবশ্য তালাক দেওয়ার পর কিছুক্ষণ দেরী করিয়া যদি ইন্‌শাআল্লাহ বলে তবে তালাক হইয়া যাইবে।

৩। যদি কেহ তাহার স্ত্রীকে “তালাক্‌ক্বী” বলিয়া ডাকে তাহাতেও তালাক হইয়া যাইবে, এমনকি এইরূপ শব্দ হাসি-ঠাট্টারূপে বলিলেও তালাক হইয়া যাইবে।

৪। যদি কেহ তাহার স্ত্রীকে বলে, “যখন তুমি তোমার বাপের বাড়ী যাইবে বা অমুক জায়গায় যাইবে, তখন জ্বালাক।” ইহাতে যখন সে বাপের বাড়ী যাইবে বা উল্লেখিত জায়গায় যাইবে তখন তালাক হইবে, আগে হইবে না।

৫। সরীহ্ অর্থাৎ, সুস্পষ্ট শব্দের দ্বারা তালাক না দিয়া কেনায়া অর্থাৎ, একাধিক অর্থবোধক শব্দের দ্বারা তালাক দিলে নিয়ত ছাড়া তালাক হইবে না। কাজেই তালাকদাতাকে তাহার নিয়তের বিষয় জিজ্ঞাসা করিতে হইবে। তালাকের নিয়ত থাকিলে অবশ্যই তালাক হইবে, আর যদি তালাকের নিয়ত না থাকে তবে তালাক হইবে না, কিন্তু এক্ষেত্রে হাবভাবে যদি তালাকের নিয়ত ছিল বলিয়া বুঝা যায়, অথচ তালাকদাতা মিছামিছি অস্বীকার করে, স্ত্রী তাহার তালাক হইয়া গিয়াছে বুঝিবে এবং স্বামীর নিকট হইতে পৃথক হইয়া থাকিবে।

যেমন, স্ত্রী রাগ করিয়া স্বামীকে বলিল, “তোমাতে আমাতে মিলামিশা হইবে না, তুমি আমাকে ত্যাগ কর”, স্বামী বলিল, “যাও তোমাকেত্যাগ করিলাম’, এক্ষেত্রে নিয়ত জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হয় না। কারণ, কথার ভাবেই তালাকের কথা বুঝা যাইতেছে, কাজেই এক তালাক বায়েন হইবে, এবং স্ত্রী স্বামী হইতে পৃথক থাকিতে হইবে। খোলা তালাকের বিবরণ

প্রশ্ন : স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি মিল-মহব্বত না জন্মে, তবে তাহার

কোন প্রতিকার আছে কি?

উত্তর ঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই প্রতিকার আছে। যদি স্বামীর মন স্ত্রীর সহিত না

মিশে তবে প্রথমত স্বামী সবর করিতে হইবে, স্ত্রীকে মিষ্ট ভাষায় নিজে এবং তাহার মুরুব্বীদের দ্বারা বুঝাইবে। যদি ইহাতে সংশোধন না হয়, তবে তাহার বিছানা পৃথক করিয়া দিবে, যদি তাহাতেও বুদ্ধি না আসে তবে স্বামী তাহাকে কিছু প্রহার করিতে পারে যেন শরীরে দাগ বা জখম না হয়। *অবশেষে স্বামী তাহাকে তালাক দিয়া দিতে পারে। কিন্তু তালাক দেওয়ার সময় প্রথমে এক তালাক দিবে,একত্রে তিন তালাক দেওয়া গোনাহের কাজ।

প্রশ্ন : ইহা তো হইল স্বামীর জান বাঁচাইবার উপায় । যদি স্ত্রীর মন স্বামীর সহিত না মিশে তবে স্ত্রীর জান ছুটাইবার কোন উপায় আছে কিনা?

উত্তর ঃ হাঁ, নিশ্চয়ই আছে। পিতা-মাতা কন্যাকে বিবাহ দিয়াছে, স্বামী মেয়েকে খুবই মহব্বত করে, কিন্তু মেয়ের স্বামীর প্রতি মন বসে না, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মনের মিলন নাই, স্বামী স্ত্রীর খোজ-খবর লয় না কিম্বা তালাকও দেয় না, এরূপ বিপদগ্রস্তার জান বাঁচাইবার জন্যই শরীয়ত খোলা তালাকের বিধান জারি করিয়াছে। স্ত্রীর মন যদি স্বামীর সহিত না মিশে তবে প্রথমেই তালাক বা খোলা তালাক চাহিবে না।

প্রথমে ধৈর্য ধরিয়া যথাসাধ্য মনের মিল করার চেষ্টা করিবে, ইহাতে যদি কোন প্রকার ফল না হয় এবং ধৈর্যধারণ করাও সম্ভবপর না হয়, তবে স্ত্রী স্বামীকে বলিবে,“আপনার জিম্মায় আমার মোহরের যে পরিমাণ টাকা আমি পাওনা আছি, আমি তাহার দাবী করিব না, আপনি আমাকে রেহাই দিন।” এইরূপ বলাতে স্বামী যদি সেই মজলিসেই বলে যে, আমি তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম, তবে স্ত্রীর প্রতি এক তালাক বায়েন অর্পিত হইবে।

অবশ্য স্বামী যদি ঐ মজলিসে কিছু না বলে বা কোন উত্তর না করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করে কিম্বা স্বামীর কোন কথার অপেক্ষা না করিয়া যদি স্ত্রী চলিয়া যায়, ইহার পর স্বামী তালাক দিলেও তালাক হইবে না।খোলা ব্যতীত অন্য যে কোন প্রকার তালাকই স্বামী দেওয়ার সাথে সাথে স্ত্রীর প্রতি অর্পিত হইয়া থাকে; ইহাতে স্ত্রীর পক্ষে তাহা কবুল করা বা না করার কোন প্রয়োজন হয় না, কিন্তু খোলা তালাক তদ্রুপ নহে। স্বামী যে মজলিসে খোলা তালাক দিবে ঐ স্থানে স্ত্রী তাহা কবুল না করিলে খোলা দুরস্ত হইবে না।

টাকা-পয়সার উল্লেখ না করিয়া স্বামী কেবলমাত্র যদি এইটুকু বলিয়া দেয় যে, আমি খোলা করিলাম, স্ত্রী যদি বলে, আমি কবুল করিলাম, তবে তালাক হইবে ও বিবাহ সম্পৰ্কীয় দেনা-পাওনা সব মাফ হইয়া যাইবে। যদি স্বামী বলে, “আমি একশত টাকার বিনিময়ে খোলা করিলাম এবং স্ত্রী যদি তাহা কবুল করে, তবে স্ত্রী মোহরও পাইবে না এবং স্বামীকে তাহার একশত টাকা দিতে হইবে।

স্বামী নাবালেগ বা পাগল হইলে খোলা করাইবার কোন উপায় নাই। তাহাদের পক্ষ হইতেও কেহ খোলা করিতে পারিবে না, আর স্ত্রী যদি নাবালেগা বা পাগলী হয় এবং তাহার অভিভাবক টাকার জিম্মা হইয়া খোলা করিয়া লয় এবং নাবালেগার স্বামী খোলা করিয়া দেয়, তবে তালাক হইয়া যাইবে বটে, কিন্তু মোহর মাফ হইবে না। স্ত্রী যদি খোলা করিতে স্বইচ্ছায় রাজী না হয়, স্বামী মারপিট করিয়া বা ধমকাইয়া খোলা করাইয়া লয়, তবে তালাক হইবে বটে, কিন্তু স্ত্রীর পক্ষ হইতে স্বামী টাকা পাইবে না বা মোহরও মাফ পাইবে না।