বাংলা কাব্য-সাহিত্যের অঙ্গনে কবি কাজী নজরুল একটি বিস্ময়কর নাম। তিনি তাঁর কাব্য-সাধনার মাধ্যমে এনেছেন কালবৈশাখীর ঝড়, প্রমত্ত প্রভঞ্জনের বেসামাল আলোড়ন, এবং পরাধীন জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে সঞ্চারিত বাংলা কাব্যে নিনাদিত করেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী চির-যৌবনের জয়ধ্বনি, অগ্নিবীণার সুর-ঝংকার। তিনি বাংলা কাব্যে বয়ে করেছেন তপ্ত শোণিত-ধারা। তাঁর কবিতাগুলো পরাধীন ভারতের অবদমিত জনগণের জন্যে সঞ্জীবনী মন্ত্র। তাঁর সংগীতগুলো নিপীড়িত, শোষিত, সর্বহারার বেদনার বাণী।
কাজী নজরুল আগে কবি রবীন্দ্রনাথের কাব্য-সুষমার ব্যাপ্তিতে বাংলা কাব্য-সাহিত্যের বিশাল অঙ্গন ছন্দলাপিত্যে ভরপুর ছিল। কাজী নজরুল আগে কোন কবি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে সে অঙ্গনে প্রবেশ করতে সমর্থ হন নি। এ সময় নজরুলই একমাত্র কবি যিনি সম্পূর্ণ রবীন্দ্র-প্রভাব-মুক্ত হয়ে স্বকীয় কাব্য-বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়ে বাংলার সাহিত্য অঙ্গনে আবির্ভূত হন। নজরুল আমাদের প্রাণের কবি। আমার প্রিয় কবি।
লোক প্রশাসন কি সংজ্ঞা ও বিস্তারিত আলচনা
সুশাসন কি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা
ভাষা আন্দোলনের পটভুমি
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালে ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির মোহাম্মদ, মাতার নাম জাহেদা খাতুন; তাঁদের চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম হওয়ায় তাঁর নাম রাখা হয় ‘দুখু মিয়া’। কাজী নজরুলের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিহার প্রদেশের অধিবাসী। আসানসোলে এঁরা কাজীর (বিচারক) দায়িত্ব পালন করতেন। নজরুল বাল্যকালেই পিতামাতাকে হারান।
কৈশোর ও প্রথম যৌবন :
পিতামাতাকে হারিয়ে কিশোর নজরুল নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে মুখোমুখি হন এবং অভিভাবকহীন অবস্থায় চরম বেসামাল হয়ে পড়েন। এ সময় লেটো গানের দলে গীত রচনা ও সুর-সংযোজন করার প্রয়াসের মধ্যে নজরুল প্রতিভার প্রথম বিকাশ ঘটে। পরে নজরুল মাংসের দোকানে এবং রুটির দোকানে মাত্র কয়েক টাকা বেতনে চাকরি গ্রহণ করেন। অতঃপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি সিয়ারসোল উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন।সেনাবাহিনীতে যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে তিনি “হাবিলদার” পদে পদোন্নতি লাভ করেন। সৈন্যদলে থাকা অবস্থায় তাঁকে পেশোয়ার থেকে মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত যেতে হয়।
এর ফলে তিনি বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান হলে, তিনি সৈন্যদল থেকে ছাঁটাই হন। তখন তিনি স্বদেশে ফিরে এসে হাজির হন দেশের শ্রেষ্ঠ শহর কলকাতায়। যুদ্ধক্ষেত্রের ট্রেঞ্চে বসে তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর “মুক্তি” কবিতা। এ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার একটি পত্রিকায়। এবার তিনি বিদ্রোহের বহ্নিচ্ছটা নিয়ে বাংলার কবিতা- আসরে অবতীর্ণ হন। পুরাণ-কোরআন-গীতা-মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবি-ফারসি-সংস্কৃত বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের চাবিকাঠি ছিল তাঁর হাতে।
আর ছিল তাঁর সংগীতপ্রিয়তা এবং সংগীত শাস্ত্রে অগাধ ব্যুৎপত্তি। ফারসি-গজল গানেও ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। এছাড়া, তিনি সিনেমার একজন দক্ষ অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেছেন। এসব সিনেমায় নিজের সুরারোপিত গানগুলো নিজেই গেয়েছেন। ছোটদের জন্যেও তিনি অসংখ্য ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। ‘খুকু ও কাঠবেড়ালি’, ‘লিচু চোর’, ‘বীরপুরুষ’, ‘বাবুরাম সাপুড়ে’, ‘বাবুদের তাল পুকুরে’-তাঁর উল্লেখযোগ্য ছড়া ও কবিতা।
আমাদের ছোটবেলায় কবিতার হাতে খড়ি হয় তাঁর কবিতা দিয়ে—
‘ভোর হল, দোর খোল, খুকুমণি ওঠ রে! ঐ ডাকে জুইশাখে ফুলখুকী ছোট রে!’ জাগাতে চাইলেন, তাই তিনি অজস্র গান ও কবিতা রচনা করে চললেন। তার গান ও কবিতার বাণী ও ছন্দে জাগ্রত হল জাগরণ ও যৌবনের কবি : নজরুল ছিলেন জাগরণ ও যৌবনের কবি। তিনি কবিতা ও গানের মাধ্যমে জড় জনগণকে পরাধীন দেশের চেতনা-শূন্য জনগণ. বিশেষ করে যুবশক্তি। কবি বিদ্ৰোহী-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভেঙে ফেলতে চাইলেন শোষণ-শাসনের শৃঙ্খল মুক্ত করতে চাইলেন চির-বঞ্চিত নিপীড়িত জনগণকে। তাঁর কবিতার ছন্দ দোলায় পরাধীনতার অভিশাপে সারা দেশ জর্জরিত। ধনিক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সীমাহীন শোষণে সমগ্র সমাজে রচিত দুলে উঠল সমগ্র দেশ। দেশবাসী শুনতে পেল তাঁর কবিতায় মুক্তির বাণী। দেশের মাটিতে ফিরে এসে নজরুল দেখলেন হয়েছে কঙ্কালাকীর্ণ এক বিশাল শ্মশানভূমি। তখন তিনি লিখলেন:
‘কারার ঐ লৌহকপাট / ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
রক্ত-জমাট শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী।’
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হল—
‘আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস / আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।
বিদ্রোহের বাণী-সমৃদ্ধ তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি,’ ‘সর্বহারা,’ ‘ফণিমনসা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ অত্যাচার, অবিচার, অনাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ খড়গ অভিযানের শামিল, বিদ্রোহের সোচ্চার জয়ধ্বনি। তাঁর কণ্ঠে যেভাবে বিদ্রোহের বাণী উচ্চারিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নেই। তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠের উচ্চারণ- দৃপ্ত
‘বল বীর—
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।
বিশ্বায়ন কাকে বলে এবং বিশ্বায়ন এর প্রভাব
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংক্ষিপ্ত জীবনী
সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত এবং ফযীলত
কারাবরণ :
দেশের সেবায় তিনি আত্মত্যাগ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। বিদেশি ইংরেজ শাসক নজরুলের কাব্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করেন। তিনি কারাগারে বসেই বহু অগ্নিক্ষরা কবিতা ও গান রচনা করেন। এতে আপামর জনসাধারণ এক নতুন সুরের স্বাদ গ্রহণ করে। নজরুল দেশকে ভালোবেসেছেন অন্তর দিয়ে। প্রচণ্ড অত্যাচার সহ্য করেছেন, তবু জন্মভূমির এতটুকু অসম্মানও সহ্য করেন নি। স্বদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রূপমুগ্ধ কবির লেখনীতে ফুটে উঠেছে— ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লি-জননী।
ফলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী। হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রী কামনা : কবি নজরুল হিন্দু-মুসলমানকে সমান চোখে দেখতেন এবং এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অটুট মৈত্রী কামনা করতেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও দাঙ্গার বিরুদ্ধে তাঁর শক্তিশালী কলমকে হাতিয়ার করেন। তিনি লিখলেন, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘পথের দিশা’, ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ ইত্যাদি। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কবিতা। তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী থেকে বেরিয়ে এলো চিরন্তন সত্য-
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনো জন?
কাণ্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
এভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির মিলন-মন্ত্র রচনা করে গেছেন নজরুল। তিনি বুঝেছিলেন যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তি ব্যতিরেকে কোনোদিনই ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করা সম্ভব নয়। তাই তিনিম সর্বাগ্রে চেয়েছেন হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও প্রীতির বন্ধন।সাম্য ও মানবতার কবি নজরুল ইসলাম : নজরুলকে বলা হয় সাম্যের কবি, মানবতার কবি। তাঁর চোখে নারী-পুরুষ ছিল সমান। নারী-পুরুষের সাম্য নিয়ে তিনি লিখেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
তাঁর কাব্যের সর্বত্রই তিনি নিপীড়িত, শোষিত, লাঞ্ছিত জীবনের জয়গান গেয়েছেন। গণমানুষের কবি নজরুল মানুষের স্থানকে নির্দেশ করেছিলেন সবার ওপরে। ঘোষণা করেছিলেন : ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ তাঁর সর্বহারা কাব্যের প্রতিটি কবিতায় গণমানুষের দুঃখ দুর্দশার ছবি পরিস্ফুট এবং তাদের প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ বোধের পরিচয় মেলে। তিনি ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় বলেন—
‘গাহি সাম্যের গান-
‘কুলিমজুর’ কবিতায়—
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান’।
‘এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
নজরুল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানবতা, মুক্তি ও সাম্যের গান গেয়েছেন। তাঁর কবিতা ও গান বাঙালিকে নতুন চেতনায় উজ্জীবিত করেছিল। তাঁর গান ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। তাঁর ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি বাংলাদেশের রণ সংঙ্গীত।নজরুলের সাহিত্য সম্ভার: নজরুল অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা ইত্যাদি। অন্যদিকে উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনায় তিনি কম কৃতিত্ব দেখাননি। তাঁর লেখা বাঁধন হারা, মৃত্যুক্ষুধা, ব্যথার দান, রিক্তের বেদন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নজরুল ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা।
কবি নজরুল যখন সাধনার শীর্ষে ঠিক তখনই অর্থাৎ ১৯৪১ সালে তিনি বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং হারানো বাক্শক্তি তিনি আর ফিরে পান নি। এর ফলে নজরুলের চির-বিদ্রোহী সত্তার অপমৃত্যু ঘটে। বহুভাবে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি। এ-অবস্থায় দীর্ঘদিন জীবন ধারণ করে দারুণ অর্থ কষ্টের নাগপাশে বন্দি থেকে জীবন-মৃত অবস্থায় কাল কাটাতে থাকেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বিশ্বনন্দিত প্রিয় কবিকে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনা হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করেন।
তিনি ঢাকাতেই পিজি হাসপাতালে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশের আপামর জনসাধারণ শোকে অভিভূত হয়ে পড়েন। ‘‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই”—তাঁর এ গানের তাৎপর্য অনুসরণ করে তাঁর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় চিরশান্তিতে শায়িত আছেন। এই অমর কবিকে উপমহাদেশ তথা বিশ্ব সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে।